Skip to content

নন্দ নাদের টুপি:এমরান কবির


    এক

    প্রায় বিশ বছর পর দেশে ফিরেছি। এত পরিবর্তন হয়েছে ভাবতেই পারছি না। আমার চেনা গ্রাম অচেনা হয়ে গেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। পতিত জমিগুলো গাছে গাছে ভরপুর। এত সবুজ! এত সবুজ আমার দেখা আগের গ্রাম ছিল না। বেশ ভালো লাগে। কবুর হাট আর কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঝে অনেকগুলো বাড়ি হয়েছে। প্রায় বিল্ডিং বলা চলে। তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে মোবাইল ফোনের টাওয়ার তালগাছের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের খেলার মাঠটা অর্ধেক হয়ে গেছে। অর্ধেক চলে গেছে মাদ্রাসার পেটে। এই মাঠে দাঁড়িয়ে আমি আমার শৈশব খোঁজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। কারণ সেই মাঠ তো নেই। মাঠের সবুজ ঘাস- যেখানে আমার পায়ের ছাপ পড়েছিল। লক্ষ্য করে দেখলাম। এই সবুজ সেই সবুজ নয়। ঘাসেরও এক ধরনের গন্ধ থাকে। গন্ধ না বওে সুবাস বলাই ভালো। আমার নাকে সেই সুবাস এলো না। ডাব গাছ ছিল মাঠের কিনারা ঘেষে। সেটা দুরে চলে গেছে মাদ্রাসার প্রাচীর মাঠের দিকে এগিয়ে এসেছে বলে। ডাব গাছের ছায়ার সাথে কত কথা হতো আমাদের। ভয়ঙ্কর রোদের মধ্যে ফুটবল খেলতে খেলতে হাঁপিয়ে ওঠার পর ডাব গাছের ছায়াই ছিল আমাদের জিরানোর একমাত্র ভরসা। ডাব গাছের ওই ছায়াই বলে দিত এখন শরৎ। ওই ডাব গাছের ছায়াই বলে দিতে এখন হেমন্ত। দীর্ঘ ছায়া হঠাৎ ছোট হয়ে আসত। উষ্ণরোদ হঠাৎ নরম হয়ে যেত। রঙ বদলে যেত। ওই বদলে যাওয়া রঙ আমাদের চোখে ঠিকই ধরা পড়ত। আজ এতদিন পর এখানে দাঁড়িয়ে আমি সেই রোদ খুঁজলাম। আসলে দিন তো চলে গেছে। দিন চলে গেলে কি আর চলে যাওয়া দিনের রোদ আসে! আসে না। তবুৎ আমার স্মৃতিকাতর মন ওই রোদ খোঁজে। পায় না।

    আমরা সন্ধ্যা অবধি ফুটবল খেলতাম। মাগরিবের আজানের পর মাঠ সংলগ্ন পুকুরে গোসল করতাম। গোসল করতে করতে প্রায়ই মুখ-দেখা-যায়-না- এমন অন্ধকার হয়ে যেত। গোসল সেরে গা মুছতে মুছতে চলত একটু আগে গত হয়ে যাওয়া খেলার বিশ্লেষণ। এরই মধ্যে ঘন অন্ধকার হতে না হতেই আকাশে দেখা যেত প্রকাণ্ড চাঁদ। ঘন আঁধার ভেদ করে পূব দিকের বাঁশঝাড়ের ওপর দিয়ে এমন চাঁদের আলো আসত যে একটু আগে দাপিয়ে বেড়ানো মাঠটাও অচেনা হয়ে যেত। মাদ্রাসা থেকে সম্মিলিত পড়বার আওয়াজ, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, আরো নাম না জানা জোসনা খেকো পাখি আওয়াজ শুরু করত। সবুজ ঘাসগুলো কেমন রহস্যময় হয়ে উঠত। হালকা কুয়াশার মধ্যে আমরা তখন বাড়ি ফিরতাম। পার্শ্ববর্তী কোনো বাড়ির হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো দেখা যেত দূর থেকে। চামচিকা আর বাদুড়েরা প্রায়ই পথ ভুল করেতা এই চাঁদের আলোয়। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার আগে আমরা সন্ধান পেয়ে যেতাম পেঁচার। আমাদের বাস্তভিটায় ছিল প্রকান্ড এক তেঁতুল গাছ। সেই তেঁতুল গাছেই আমরা প্রথম আবিষ্কার করি পেঁচার। কী গোল গোল চোখে পলকহীন চেয়ে থাকতো আমাদের দিকে। মাঝে মাঝে মুখ ভ্যাংচাতো। আর ঘাড় ঘুরাতো। মুখ ভ্যাংচানোর পরই আমাদের বালক দলের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যেত। সম্মিলিত আওয়াজ আসতো, ‘গালি দিলো শালা। ঢিল দে শালারে, ঢিল দে শালারে।’ আমাদের প্রস্ততি থাকতোই। হাতে হাতে ঢিল। আমরা যেন পেঁচার মুখ ভেংচানির জন্য অপেক্ষা করতাম। মুখ ভেংচালেই শুরু হয়ে যেত সম্মিলিত ঢিল। ওই ঢিলের তোড়ে থাকতে না-পেরে পেঁচা উড়াল দিতো। উড়ে গিয়ে পড়তো প্রথমে আবুলের মায়ের আম গাছে। আমরা দৌড় লাগাতাম। আমরা পৌঁছানোর আগেই পেঁচা পৌছে যেত। আমরা গিয়ে আবার বিভিন্ন ধরনের কথা বলতাম। পেঁচাও আমাদের চোখে চোখ রেখে চোখ পাকাত। যেই না মুখ একবার বাঁকা করেছে ওমনি শুরু হয়ে যেত ঢিল বর্ষণ। পেঁচা এবার উড়াল দিত আকন্দ পাড়ার আম্মাদ আলীর পাকুড় গাছে। আমরা দৌড় লাগাতাম। সেখানেও একই ঘটনা ঘটত। আমাদের ঢিল খেয়ে পেঁচা তখন উড়ে যেত টাকি পাড়ার শেঁওড়া গাছে। মাঝে মাঝে সেখান থেকে পেঁচাটা নিঁখোজ হয়ে যেত। আগের গাছগুলোয় ঢিল মারলেও এই গাছে বসা পেঁচাকে আমরা ঢিল দিতাম না। এর প্রধান কারণ শেওড়া গাছে নাকি পেত্নি থাকে। ঢিল দিলে যদি ভয় দেখায় রাতের বেলা! দ্বিতীয়ত আমরা প্রায়শই ওই গাছের ডালে পেঁচা এসে বসলেও খুঁজে পেতাম না। কেউ কেউ বলাবলি করতো পেঁচাটা আসলে ভুত। কেউ বলত এখানে আসার পর পেত্নি তাকে লুকিয়ে রাখে। ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে যেত। আমরা যে যার মতো বাসায় ফিরে আসতাম।

    আমার বয়সী বাদে জুনিয়র কোনো ছেলেমেয়ে আমাকে চেনেই না। শুধু নাম জানে। নিজের গ্রামে নিজেই অচেনা হয়ে গেছি।
    সবচেয়ে পরিবর্তনটা হয়েছে কবুর হাটে। একসময় হাট ছিল। এরপর কয়েক দশক বিরান পড়েছিল। মিলন নামের এক বেকার তরুণ প্রথমে ছোলা সিদ্ধ আর বুন্দিয়ার দোকান দিলো। তারপর তাঁর ব্যবসা বাড়তে বাড়তে হোটেল হোলো। একজন সবজি নিয়ে বসলো। তার দেখাদেখি একজন মাছ নিয়ে বসল একদিন সকালবেলা। এক কিলোমিটার দূরে ন্যাংড়ার বাজারে যাওয়ার চাইতে এখন থেকে কিনতে কী সমস্যা। সপ্তায় সপ্তায় গরু জবাই হতে লাগলো। এভাবে জায়গাটা বিশাল বাজারের আকার ধারণ করল। এখন রীতিমতো কয়েক এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার। কী নেই এখানে! রীতিমতো শহরের মতো কারবার।
    আব্বা আর আমি হাঁটছি। আব্বা আমাকে বর্ণনা দিচ্ছেন সবকিছুর। যেন ট্যুরিস্ট গাইড। আব্বা দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। এখন নানারকম সামাজিক কার্যক্রম তথা সমাজ সেবায় জড়িত।হাঁটতে হাঁটতে একটা হোমিও ঔষধালয়ের সামনে এসেছি। আব্বা বলছেন, ‘এটা নন্দ নাদের হোমিও দোকান। নন্দ নাদকে মনে আছে তোমার?’
    আমি মনে করার চেষ্টা করছি।
    আব্বা বললেন, ‘ভুলে গেছ? হিন্দু পাড়ায় হামলা হলে যে ছেলেটি মারমুখী জনতার সামনে একাই সাহস করে দাঁড়িয়েছিল। সেই নন্দ নাদ। সে অনেক আগের কথা। তুমি তখন হাইস্কুলে সবে ভর্তি হয়েছো।’
    আমি বললাম, ‘বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়?’
    ‘হ্যাঁ। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজীবনের চেনা মানুষগুলোও অচেনা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মুসলমানদের একটা উগ্র অংশ বড় কুমিরার হিন্দু পল্লীতে আক্রমণ করেছিল। যে যার মতো পালালেও নন্দ নাদের অমিত তেজের সামনে স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল মারমুখী জনতার ক্রোধ। কারণ নন্দ নাদ সবার সাথে সমানভাবে মিশত। জনতার মধ্যে তার সাথে মেশা মানুষজনও ছিল। পরে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলেও নন্দ নাদ ঠিক হলো না। এক বিরাট অভিমান তাঁর ভেতরে জেঁকে বসেছিল। যে মানুষগুলোর সাথে সারাজীবন মিশলো, সুখে দুখে একসাথে দিন কাটালো তারাই কীরকম অচেনা হয়ে গেল দূর দেশের এক মসজিদ ভাঙা নিয়ে। আসলে তাঁর হৃদয়টাই ভেঙে গিয়েছিল।’
    আব্বা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘মানুষের হৃদয় ভাঙা খুব বড় ধরনের অমানবিকতা। এর রক্তক্ষরণ দেখা যায় না। কিন্তু সমাজে ছাপ পড়ে ভয়ঙ্করভাবে।’
    আমি আব্বার মুখের দিকে তাকাই। আশির কাছাকাছি বয়স। দুই একটা দাঁত আছে। চুল দাড়ি সব পেকে শাদা। সাদা জোব্বায় ঢাকা পুরো শরীর। আব্বাকে ঠিক মানুষ মনে হয় না। আমার বাবা বলে বলছি না এই কথা। আব্বাকে দেবদূত মনে হয়।
    আব্বা হাঁটতে হাঁটতে থামেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ তুমি তো লেখালেখি করো। পড়াশুনা ভালো। তুমি কী ভাসানী ও তারাশঙ্কর বন্দ্যাপাধ্যায়ের ঘটনাটা জানো?’
    আমি বললাম, ‘ টাঙ্গাইলে গ্রামের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলেছিলেন তাঁরা?’
    ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তুমি তো জানোই। তবুও বলি। ভাসানির উদ্যাগে সংঘঠিত টাঙ্গাইলে সাহিত্য সম্মেলনে তারাশঙ্কর বন্দ্যাপাধ্যায় এসেছিলেন। গ্রামের রাস্তায় সন্ধেবেলা হাঁটতে হাঁটতে ভাসানি বললেন জানেন তারা বাবু, এখানে আগে মন্দিরে সন্ধেবেলা কীর্তন গাওয়া হতো, ঢোল তবলা বাজতো, ধুপের ধোয়া মিশে যেত সন্ধের আলো আঁধারির সাথে। এখন আর বাজে না। তারাশঙ্কর থেমে গেলেন। বললেন, আপনি না মাওলানা মানুষ! হিন্দুদের পূজা অর্চনা নিয়ে এভাবে কথা বলছেন! ভাসানি বললেন, এটাই তো বৈচিত্র্য। একটা দেশে সব ধরনের মানুষ সুন্দরভাবে বসবাস করবে। এটাই তো সৌন্দর্য।’
    আব্বা একটানে কথাগুলো বললেন। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলেন। আমি তাঁর পাশে হাঁটছি। ছোট বেলায় এরকম হাঁটার সময় আব্বার শাহাদাত আঙুল ধরে হাঁটতাম। সে-আঙ্গুলের স্পর্শ এখনো হাতে লেগে আছে। ইচ্ছে করছে আব্বার শাহাদাত আঙুলটি আবার ধরে হাঁটি।
    ‘নন্দ নাট সেই থেকে নিখোঁজ।’ আব্বা বললেন।
    আমি বললাম, ‘ফিরলো কবে।’
    ‘ফিরলো প্রায় বিশ বছর পর।’
    ‘কোথায় ছিল এতদিন?’
    ‘শোনা যায় কোনো এক আশ্রমে ছিল। সেখান থেকে হোমিও চিকিৎসার ট্রেনিং নিয়েছে। একটা সার্টিফিকেটও দেখায়। ফিরে এসে এখানে হোমিওপ্যাথির দোকান দেয়। কিন্তু সে-কাজটাও তাঁর জন্য সহজ ছিল না। কারণ সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম এলাকায় হিন্দুর হোমিওপ্যাথির ব্যবসা! ওরা বড় জোর চুলটুল কাটবে অর্থাৎ নাপিত হবে বা জুতা শেলাই করবে, রঙ করবে- এরকমই তো ভাবে মানুষজন। তাই বলে হোমিওপ্যাথির ব্যবসা! বাজারের লোকজন, স্থানীয় গ্রাম্য ডাক্তার, ওষুধের দোকান কিংবা এলাকার প্রভাবশালী- কেউই চায়নি নন্দ নাদ এখানে ফার্মেসি খুলুক, চিকিৎসা দিক বা স্থায়ী হোক।
    তবুও বীরদর্পে তাঁর দোকানঘরটি দাঁড়িয়ে যায়। বুক উঁচু করে। কাজটি সম্ভব হয় ছলিমদ্দির ছেলে কলিমদ্দির কারণে। ছোটবেলায় এই ছলিমদ্দির ছেলে কলিমদ্দির পানিতে পড়ে মারাই যাচ্ছিল। নন্দ নাদ তাকে উদ্ধার করে। এই কৃতজ্ঞতাবোধ কলিমদ্দি ও তাঁর পরিবার কোনোদন ভোলেনি। এদিকে ছলিমদ্দির ছেলে কলিমদ্দিও এতদিনে বড় হয়ে গেছে। এলাকায় তাঁর বিপুল প্রভাব। তাঁদের প্রভাবেই এই অসম্ভবটি সম্ভব হয়ে যায়।
    তবে এলাকাবাসির জন্য এক বিশাল বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।’
    আমি বললাম, ‘কী সেটা?’
    আব্বা বললেন, ‘নন্দ নাদের দোকান শুরুর এক সপ্তাহও হয়নি, একদিন স্বয়ং এমপি এসে হাজির । কারো কাছে না গিয়ে সরাসরি এমপি সাহেবরে গাড়িবহর গিয়ে থামে নন্দ নাদের দোকানের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি নন্দ নাদের সামনে গিয়ে হাজির।
    চাঁদ নেমে এসে হেঁটে হেঁটে নন্দ নাদের দোকানে ঢুকলেও যতটা না বিস্মিত হতো তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয় বাজারের লোকজন। সবার মুখ হা হয়ে যায়। গাড়ি আর মোটরবাইকে ভরে যায়। বিশাল জটলার সৃষ্টি হয়। উৎসুক জনতার উদ্দেশে এমপি সাহেব বীর দর্পে ঘোষণা করেন- নন্দ নাদ আমার বড় ভাই। এমন বড় ভাই যা মায়ের পেটের চেয়েও অধিক।
    এরপর থেকে নন্দ নাদকে কেউ বিরক্ত করেনি। তাঁর পসার বাড়ছে তো বাড়ছেই। গোপনে হিংসায় জ¦লে গেলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলছে না।’


    দুই


    আমি দেখলাম সত্যিই অনেক লোকজন তার সেবা গ্রহীতা হিসেবে। আমি আব্বাকে বললাম, ‘আব্বা অনেক কিছুই তো জানলাম। কিন্তু তার পরিবার সম্পর্কে তো জানা হলো না।’
    আব্বা বললেন, ‘কেউই তা জানতে পারেনি। ওর বাবা-মা-ভাই-বোন বছর দশেক আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। মানুষ বলাবলি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। এরপর বছর দশেক পরে যখন নন্দ নাদ ফেরে ততদিনে তাঁর জমি জিরেত সব বেহাত হয়ে যায়। সেগুলো এখনো ঠিকঠাক মতো উদ্ধার করতে পারেনি।’
    কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে আমরা তাঁর দোকানের সামনে চলে আসি। অপেক্ষমান রোগী, তার সহকারী, বসবার টুল, কাঁচের বোতল, আর অদ্ভুত মাদকতাময় সুবাসের ভেতরে তার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। নন্দ নাদ! আমার দিকে চেয়ে থাকেন অপলক। আমিও।
    আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে অপলক ফিরে যাই আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে।
    মাছ ধরবার প্রচন্ড নেশা ছিল আমার। খাল-বিল-জমি সব জায়গায় চষে বেড়াতাম। বরষাকালে কিছু জমি রীতিমতো নদী হয়ে যেত। শুষ্ক মৌসুমেও পানি শুকাতো না। মাছ পাওয়া যেত সবসময়ই।
    এরকম এক জায়গায় আমি মাছ ধরতে ধরতে তলিয়ে যেতে থাকি। আমার দুই পা দেবে যেতে যেতে হাঁটু অব্দি পৌছে যায়। কোত্থেকে নন্দ নাদ এসে আমাকে ধরে ফেলে। ‘ওই ইমরান তুমি ওইকানে গ্যাচো ক্যা। ওইডা তো বালিচোর।’
    আমি জানি চোরাবালি কী জিনিস। নন্দ নাদ সেখান থেকে আমাকে বাঁচায়। কাউকে সে-কথা বলা হয়নি আমার। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়নি। অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানানো কী জিনিস তখন জানতাম না। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের যে আদবকেতা তা তো তখন শিখিইনি। সেদিন অনেক মাছ পেয়েছিলাম আমি। আমাকে উদ্ধার করবার সময় অসতর্কতায় মাছগুলো পড়ে যায়। জীবন নিয়ে টানাটানি। মাছের চিন্তা কি মাথায় থাকে।
    চোরাবালি থেকে উদ্ধার হবার পর যখন একটু ধাতস্ত হয়েছি। তখন খেয়াল করি আমার খলুইয়ে একটা মাছও নাই। সব পানিতে পড়ে জীবন ফিরে পেয়েছে। আমিও নন্দ নাদের সৌজন্যে আর মাছগুলোর জীবনের বিনিময়ে জীবন ফিরে পেয়েছি।
    সবাই জিজ্ঞাস করে তোমার মাছ কই। আমি কিছু বলতে পারি না।
    চোরাবালি থেকে জীবন পেয়েও মাছের জন্য আমার শোক বইতে থাকে বুকের ভেতরে। আজ বহুদিন পর সেই শোক ও ব্যথা অনুভব করি নতুন করে। তবে সেই শোক ও ব্যথা মাছের জন্য নয়। ঠিক কিসের জন্য বলতে পারি না। নন্দ নাদের জন্য কি?
    আমাকে দেখে নন্দ নাদ তাঁর আসন ছেড়ে নেমে আসেন। লম্বাটে মুখ। লাল ফর্সা মানুষ। ক্লিনড শেভ। মাথায় কিস্তি টুপি।
    আমার সামনে এসে তিনি নমস্কারের ভঙ্গি করেন। আমি হাত বাড়িয়ে দেই। এলাকার কিছু লোক অপলক চেয়ে থাকে। যেখানে আমাকে বেশিরভাগ লোকই চিনছে না সেখানে এই হোমিও ডাক্তার কীভাবে চেনে! যে হোমিও ডাক্তার নিখোঁজ থাকে ত্রিশ বছর আর যে লোক বিশ বছর পর দেশে ফেরে তাদের ভেতরে যোগাযোগ হয় কীভাবে!
    তিনি এক স্নিগ্ধ হাসি দেন। এরকম স্নিগ্ধ হাসি আমি আমার বাবা ছাড়া কারো ভেতরে দেখিনি। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ‘আমাকে চিনেছেন? আমি আপনাকে চিনেছি। বিদেশে থাকলেও দেশের জন্য আপনার অনেক মায়া। আমি আপনার লেখা পত্র-পত্রিকায় পড়ি। সেখানে ছবি দেখি। আপনার তিনটা বই আমার কাছে আছে। আপনি অনেক গুনী লোক।’ নন্দ নাদ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলতে থাকেন।
    আমি শুধু একটি কথাই বলতে পারি, ‘আসল গুনী মানুষ আপনি। আপনার ভেতরে অনেক আলো।’
    তিনি লজ্জায় নুয়ে পড়েন। বলেন, ‘আপনি যদি আমার এখানে একটু বসেন আমি শুধু আনন্দিত হবো না। ধন্য হয়ে যাব।’
    তিন
    নন্দ নাদের চেম্বারে বসে আছি। বাহিরে উৎসুক জনগণের ভিড়। তিনি তাঁর খাস চেম্বারে নিয়ে যান আমাকে। তাঁর আসনের উপরে দুইটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। একটা হিন্দুদের দেবদেবীর ছবি। অন্যটা কাবা শরীফের।
    ছবি দুটোর দিকে আমার তাকিয়ে থাকা দেখে নন্দ নাদ স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলেন, ‘লেখক সাহেব, গভীরে আসলে কোনো বিরোধ নেই। একই।’
    কথাটা আমার ভেতরে অনুরণন তোলে। মন থেকে হৃদয় থেকে মস্তিষ্ক থেকে বের হয় না।
    চার
    অবকাশ সময় কাটাচ্ছি। কোনো ব্যস্ততা নেই। কিন্তু নন্দ নাদের কথাটা মাথায় গেঁথে গেল একদম। ‘লেখক সাহেব গভীরে আসলে কোনো বিরোধ নেই। একই।’ সত্যিই। অনেক বিষয়েরই বাহিরে আলাদা হলেও ভেতরটা একই। পার্থক্যহীন। আমরাই খালি খালি বাহ্যিক পার্থক্য গড়াই। আর সেটা নিয়ে স্বার্থপর বিরোধে মাতি।
    আজকেও বিকেল বেলা হাঁটতে বের হয়েছি। আমার সহপাঠি মালেকের সাথে দেখা। মালেককে দেখে আমি চমকে উঠি। তাকে চেনাই যাচ্ছে না। টুপিতে দাড়িতে আলখাল্লায় সে এক অন্যরকম অবস্থা। অথচ এই মালেক ছিল সবচেয়ে ফ্যাশনেবল, আধুনিক।
    ‘মালেক না?’
    এতদিন পর দেখা। মালেক উচ্ছসিত হবে আমার মতো। অথচ সে নিভে গেল। বিরক্তও হলো। বলে, ‘মালেক বোলো না। আবদুল মালেক বলো। সবচেয়ে ভালো হয় আবদুল্লাহ নামে ডাকলে।’
    ‘কেন। মালেক বললে সমস্যা কী। আর তোমার নাম আবদুল্লাহ হলো কবে থেকে।’
    ‘মালেক বললে শিরক হয়ে যায়। আবদুল মালেক বলতে হবে। তুমি তো শিরক করে ফেলেছে। তুমি কাফের হয়ে গেছো।’
    আমি স্থির দৃষ্টি দিয়ে মালেকের দিকে তাকিয়ে থাকি। যে কলেজ জীবনে এসেও সবার জন্য বিব্রতকর ছিল। এলাকার মানুষের ফল চুরি, মুরগি চুরি, মাছ চুরি করে পিকনিক- সবকিছুর হোতা ছিল। মেয়েদেও সাথে ধোকা দিয়ে সম্পর্ক করত একের পর এক। পরে কেটে পড়তো। বলতো, ‘মেয়ে মানুষ হলো পায়ের জুতা। কিছুদিন ঢুকানোর পর ফেলে দিতে হয়।’ সে আজ আমাকে কী কথা বলে এত দিন পর দেখা হয়েও!
    আমিই কথা ঘুরাই। বলি, ‘ছেলে মেয়ে কয়জন। কী করে।’
    মালেক বলে, ‘তিন ছেলে দুই মেয়ে। সবাই মাদরাসায় পড়ে। পাক্কা আলেম হয়ে বের হবে। তোমার ছেলে মেয়ে?’
    ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে।’
    মালেক এবার কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘থাকো তো বিদেশে। ওরা কি কলমা টলমা জানে? না-কি ইহুদি খ্রিস্টান হয়ে গেছে?’
    আর থাকা যায় না। এরা যে এত বাজেভাবে নষ্ট হয়ে গেছে তা জানা হলো। আমি জানি এ পর্যায়ের কোনো মানুষকে এখন কিছু বলে লাভ নাই।
    মালেক আবার বলে, ‘কাল তোমাকে দেখলাম মালাউনটার আখরায়। নন্দ কে নিয়েও কবিতা লিকবা না-কি। নন্দ নাদ, তুমি আমাদের চাঁদ।’
    বাড়িতে ফিরে আসি। গতকাল মনটা প্রসন্ন হয়েছিল। আজ আঁধারে ভরে গেল। আজ আর আমি কোথাও যাব না।
    পাঁচ
    জরুরি কাজে ঢাকায় আসি। সপ্তাহখানেক লেগে যায়। আরো দুই-একদিন লাগবে। এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে যায়। আব্বা আমাকে বিস্তারিত জানায়।
    আমি ঢাকায় আসার দুইদিন পরেই নন্দ নাদের লাশ পাওয়া যায়। তার চেম্বার থেকে বেশ দূরে। ঈদগাহ মাঠ পার হয়ে একটু দূরে। খোন্দকার পাড়ার কাছে জমির ক্ষেতের ভেতরে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তার হত্যা বা মৃত্যুর পরপরই তার লাশ নেওয়ার জন্য হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই দাবি করে। স্থানীয় মাদ্রাসার হুজুরের নেতৃত্বে মুসলমানরা দাবি করে নন্দ নাদ মুসলমান ছিল। সুতরাং তার শেষকৃত্য মুসলমানরীতিতে হবে। এদিকে তার জ্ঞাতি গোষ্ঠি যাদের কাছে নন্দ নাদ নিজেও ব্র্যাত্য ছিল তারাও দাবি করে ও তো হিন্দুই। মাঝখানে লাশ রেখে দুই পক্ষের সংঘর্ষ লেগে যায়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দেখা যায় নন্দ নাদের লাশ নেই।
    প্রথমে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষ দেয় তারা লাশ গুম করেছে। যদিও জানে সবাই যে লাশ কখনো গুম করা যায় না। জীবন্ত মানুষ গুম হয়ে থাকতে পারে- স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় । কিংবা জীবন্ত মানুষকে আটকে রাখা যায়। লাশকে কখনো আটকে রাখা যায় না। পুলিশ জেনে যায় পুরো ঘটনা। ঘরে ঘরে তল্লাশি চলে। কোথাও নন্দ নাদ নেই। কয়েক গ্রামের পুরুষ, কি হিন্দু কি মুসলমান- কেউ ঘরে নেই। শুধু একজন মানুষ ঘরে আছেন বিস্মিত হৃদয় নিয়ে। তিনি আমার বাবা।
    ঘটনার ঘনঘটায় সবাই হতবুদ্ধি হয়ে যায়। এলাকা জুড়ে নেমে আসে অদ্ভূত নীরবতা। নন্দ নাদ চলে যায়। বা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। দুই পক্ষ্য গা ঢাকা দিলেও অদ্ভুৎ নীরবতা নেমে আসে। যে যার মতো চলে যায়। রেখে যায় ছোপ ছোপ রক্ত। এ রক্ত দেখে পৃথক করা যায় না কোনটা নন্দ নাদের, কোনটা মুসলমানের, কোনটা হিন্দুর।
    ছয়
    রাতে পুলিশ আসে আমাদের বাসায়। বলে একদিন আগেই ইমরানকে দেখা গেছে নন্দ নাদের সাথে। তার সাথে কথা বলতে এসেছি।
    আমার সাধাসিধা বাবা, ধর্মপ্রাণ বাবা খুব ভয় পেয়ে যান। মা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
    আরো জানা যায় যখন নন্দ নাদের লাশ পড়েছিল জমির ক্ষেতে তখন তাঁর চেম্বারে চলতে থাকে লুটপাট। পরে দেখা যায় রক্তের দাগ লেগে আছে তার চেম্বারের সামনে। দেখা ছোঁড়া কাপড়ের অংশ পড়ে আছে। পড়ে আছে ভাঙা কাচ, চেয়ারের হাতল, হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন উপকরণ ইত্যাদি।
    সাত
    জরুরি কাজ ফেলে বাড়ি ফিরছি। পুলিশ আমাকে খুঁজছে। তাঁদের সাথে কথা বলতে হবে। আমি সন্দেহভাজন কি-না তা স্পষ্ট নয়। আমার সাবেক সহপাঠি মালেক ছড়াচ্ছে নানারকম কথা যাতে আমাকে শুধু সন্দেহই নয় যেন আমার দ্বারাই হত্যাকান্ডটি সংঘঠিত হয়েছে- এরকম বিশ্বাস দৃঢ় হয়।
    হঠাৎ আমার মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে একটি ছবি আসে একটি অজ্ঞাত ফোন নাম্বার থেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মালেকের দোকানের ভেতরে নন্দ নাদের ব্যবহার করা টুপি। আমার বুঝতে আর কিছুই বাকি থাকে না।
    বাড়িতে না-গিয়ে প্রথমেই থানায় গিয়েছি। কথা বলেছি দায়িত্বপ্রাপ্তের সাথে। এখন গ্রামে ফিরছি।
    হিন্দুরা দাবী করছে নন্দ নাদ স্বর্গে চলে গেছে। মুসলমানরা দাবি করছে নন্দ নাদ বেহেস্তে গেছে। হিন্দু মুসলমান উভয়ই দাবি করে নন্দ নাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কারণ তাঁর কোনো শত্রু ছিল না।
    আমার মাথার ভেতরে নন্দ নাদের কথাটি ঘুরপাক খেতে থাকে, ‘লেখক সাহেব, গভীরে আসলে কোনো বিরোধ নেই। একই।’

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Author
    Share this post on social!