খুব ছোটবেলা থেকেই বাবা কিম্বা না ছেলেমেয়েদের নাচ, গান, ছবি আঁকা শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রায়ই দেখা যায় বদলদাবা করে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে হেটে বেড়াচ্ছে। অথবা রঙিন প্রজাপতির মত বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা নাচ শিখতে যাচ্ছে। আমি প্রতিভাহীন মানুষ। জীবনে কোনোদিন না শিখতে পারলাম নাচ, না পারলাম শিখতে গান, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আপিল ও বাবা নাকচ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে সাধারন এই আমি ভাবতে শুরু করলাম, আরে! আমি ত চাইলেই লেখালেখি করতে পারি। তাই টুকটাক লিখালিখি করতে শুরু করলাম। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বন্ধুরা যখন নামের পাশে ট্যাগ লাগাতে শুরু করলো, লেখক সাহেব। তারপর একটা সময় পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম কিছুটা। এমনটা আমাদের এখন অনেকেরই মনে হয়। ভাবা হয়, আমি বোধহয় আর লেখক হতে পারছি না।
দমে যাওয়ারই কথা তাইনা?
শিল্প বা সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের সচরাচর এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয় শখ থেকে। এর পেছনে চর্চার বড় ভূমিকা রয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু চর্চা শব্দটির সঙ্গে যে শব্দটির যোগ ওই ডিসিপ্লিন বা অধ্যাবসায়কে আমরা কখনই লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। বোধহয় আমরা জানিইনা। তবে বাংলা সাহিত্যে পরিশ্রমী লেখকের সংখ্যা কম নয়। তুখোড় প্রতিভাবান লেখকদেরও নানা অন্তর্দন্ব থাকে। তারা লেখনিতে কাটসাট করার মধ্যে ব্যস্ত সময় পার করেন। ভাবেন, আরও কতটা সহজ করা যায়। আবার অনেকে পাঠককে কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চান। তাদের ভাবনায় থাকে, দিয়ে ফেলি চ্যালেঞ্জ। কমলকুমার পড়তে গেলে যেমনটা হয়, উনি সচেতনভাবেই পাঠককে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ছেন যেন। সেসব কথা জানার জন্য অবশ্য বইয়ের অভাব নেই।
বাদল বসুর ‘পিওন থেকে প্রকাশক’ পড়া যেতেই পারে। আবার পত্রপত্রিকায় ইতস্তত ও বিক্ষিপ্তভাবেও অনেক কিছুই জানা যেতে পারে। সাহিত্যের ময়দানে অনেক কিছুই সম্ভাব্য। আবার অনেক কিছু অনুমেয়। কিন্তু যিনি লিখে যাচ্ছেন, তার কাছে অনুমেয় তার সৃজন। তারপরও অনুমেয় এই সৃজন ভাষার গণ্ডিবদ্ধতা কিংবা ব্যাকরণ থেকে কি আলাদা হতে পারে? অন্তত সচেতন অনেক পাঠকই তা বুঝতে পারেন। একটা সময় তা হয়তো অনেকেই ভাবতেন না। এখন অনেক পাঠক বানান, যতিচিহ্ন তো বটেই, খোদ ফন্টের সাইজ নিয়েও বিরক্ত প্রকাশ করেন। এমনটিই স্বাভাবিক। পাঠকের আয়েশের তো ব্যাপার আছে। সেই আয়েশ থেকে কেন সে ছুটে যাবে? ছুটতেই বা হবে কেন?
আবার অনেকে আছেন ধরেই নেন লেখার ক্ষেত্রে চর্চার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মস্তিস্কে বা মননে প্রাণোচ্ছলতার স্ফূরণ ঘটাতে গিয়ে শেষপর্যন্ত পাঠককে দূরে ঠেলে দেয়ার মধ্যেও আমার নিজস্ব ব্যখ্যা না থাকা লেখকের এক ধরনের ব্যর্থতাই। আর অমন বিষয়টি স্পষ্ট করে যেন সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে।
মার্জিনে মন্তব্যকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর সহযোগী রেফারেন্স ধরা যেতে পারে। অন্যতম প্রধান এই অর্থে যে পোয়েটিকা নির্ভর অনেক বই আমাদের বাজারে আছে। আজকাল অনেকেই বুঝতে পেরেছেন ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সটায় লেখক হওয়ায় বীজ রয়েছে। তাদের ভাবনা ভুল না। কারণ সৃজনশীল লেখক হওয়ার জন্য শ্রম ও অধ্যাবয়াসের গুরুত্ব আছে। তবে আমাদের লেখার ক্ষেত্রে অনেক তাড়াহুড়ো থাকে। সেই তাড়াহুড়ো প্রকাশের আগে। প্রকাশের পরের তাড়াহুড়ো সৃজনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া দোষনীয়। কারণ তাতে পাঠকের সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় যে অর্থে সমালোচনার সাহিত্যকে গড়ে তোলে তা সাধারন রুচিশীল পাঠকের মুখে ঝাল বাড়িয়ে দেয়। তবে পাঠকের সমালোচনা পাতে তুলে নেয়ার কাজটি খোদ লেখক করলে বিরক্তি লাগে বইকি।
এবার তাহলে সৈয়দ হকের কথা শোনা যাক
সৈয়দ হক নিজে পরিশ্রমী লেখক। তবে সৃজনশীল লেখার কোর্সের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত হলেও একাডেমিক ধারণায় বিশ্বাসী হয়তো ছিলেন না। ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইটি এককালে যেমন তুমুল জনপ্রিয় ছিল এখন তা আর নেই। তারমানে এই নয় যে এখন বইটির আবেদন হারিয়ে গেছে। মূল বিষয় হচ্ছে, অনেকেই ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সের কারিগরি বিশ্লেষণের অনেক বই পড়তে পারছেন। কিন্তু সৈয়দ হকের এই বইটিও আমাদের অনেক কিছু দেয়। দিতে পারে। সাহিত্য শাস্ত্র বলে একটা বস্তু যে আছে সেটা অস্বীকার করা বোকামো। আপনারা হয়ত ভাবছেন, এ কি কথা রে বাপু! তুমি নাচ গান শেখার কথা আবার এই লেখালেখির কথায় জুড়লে কেন? এখানেই আমি জ্ঞানী ভাব নিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলব, আছে আছে। খুব সম্পর্ক আছে।
আমরা সবসময় মনে করে আসি আমি চাইলেই লিখতে পারি। হ্যা এটা সত্য, সবাই লিখতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন, সবার লেখাই সবাইকে আকর্ষন করতে পারেনা। এটাকে অনেকে আল্লাহর দান বলে পাড় পেতে চাইলেও এতটা সহজ না। জেমস জয়েস ইউলিসিস লেখার পর প্রায় পুরো বিশ্ব ধরে নিয়েছিলেন উপন্যাস লেখার যে মান, সেটুকু ছুইয়ে ফেলেছেন জয়েস। তারপরেও তিনি আজীবন শব্দ খুজেছেন। তারমানে লেখাও চর্চা করতে হয়। সেই কথাটাই হুট করে একটি বইয়ের প্রথম দিকে পেয়ে আমি রীতিমত অবাক। হ্যা, সৈয়দ শামসুল হকের – ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইটির কথাই বলছি।
মার্জিনে মন্তব্য একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। হাল আমলে যাকে নন-ফিকশন বলে তা-ই। তবে এখানে সৈয়দ হক কারিগরি দিক নিয়ে গেলেন না। তিনি ঝাপ মারলেন লেখাকে কাটাছেড়া করতে। একটা গল্প বা একটা কবিতাকে ধরেই যেন বুঝাতে লাগলেন, দেখো লিখতে গেলে ঝামেলা কোথায় বাজে।
প্রতিটা মানুষই একটা সময় প্রতিকী, রুপকল্পের আশ্রয় নেয়। একজন প্রেমিক আবেগে চাঁদের সাথে প্রেমিকার মুখের কল্পনা করতেই পারে। চুলের মধ্যে যদি জীবনানন্দ শ্রাবস্তীর কারুকার্য খুজে পেতে পারে তাহলে আমি কেন আমার প্রেমিকার মাঝে সমগ্র বিশ্বজগত খুজে পাবোনা? আসলে এই বিশ্বজগতটুকু আমার ভাবনার জগত এবং এই ভাবনার জগত আমি অন্য কারো মাঝে খুজে পেলেই তাকে ভালোবাসা বলি। মানুষ মুখে যতটুকু আবেগ প্রকাশ করতে পারে তারচেয়ে বেশি আবেগ প্রকাশ করতে পারে লিখে। এটুকু খুব সত্য। তারপর আসে গল্প লিখার ঢঙ, লেখকের অনুভূতি, লেখকের কারিগরি। সৈয়দ শামসুল হক দেখিয়ে দিয়েছেন গল্পের কারিগরি। বিশেষত বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার কালরূপের ব্যবহার রীতিমত অবাক করে দিয়েছে।
হোক সাহেবের মন্তব্যের কলকব্জা খুঁজে বেড়াই
অনেকেরই দাবী মার্জিনে মন্তব্য পড়লে গল্প কিভাবে লিখতে হবে শেখা যায়। কিন্তু কিভাবে একটা গল্প পড়তে হয়, কিভাবে একটা ছোট সাদামাটা গল্পও পাঠকের দৃষ্টিতে অসাধারন হয়ে উঠতে পারে সেটুকুও ভালোভাবে “মার্জিনে মন্তব্য” বইটিতে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটুকু অবশ্যই স্পষ্ট যে মার্জিনে মন্তব্য শুধুমাত্র লেখার কৌশল শেখার জন্য না, বরং পড়ার আঙ্গিক গড়ে তোলারো বই।
সৈয়দ শামসুল হক চেয়েছিলেন অন্তত এই বইটি সবাই পড়ুক। বইটির তিনটি অংশ—মার্জিনে মন্তব্য: গল্পের কলকব্জা এবং কবিতার কিমিয়া। আমি কখনই কবিতাপ্রেমী ছিলাম না। তবুও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। কবিতা লিখেছি। মার্জিনে মন্তব্য পড়ার পর কবিতা পড়ারও একটি আলাদা দৃষ্টিকোণ গড়ে উঠেছে।
মার্জিনে মন্তব্য দিয়ে সৈয়দ হক দুটো বিশাল কলেবরকে ধরলেন। গল্প পড়ার দিকে আমার মনোযোগ প্রথমটি। আর দ্বিতীয়টি হলো, লেখার সময় লেখকের মনস্তত্ব। শুরুতেই এটিকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর জন্য সহযোগী রেফারেন্স বলার অর্থ, এই বই অন্তত সরল সত্যই বলে। পড়তে হলে ভাষার ব্যবহার জানা চাই। ভাষাকে জানলে জানা যায় এর যান্ত্রিক কলকব্জা।
পড়ার দৃষ্টিকোণ গড়ে তুললে সেগুলোকে কি আদৌ ভারি ভারি বই মনে হবে? হবে না হয়তো। এ বই সেদিকে মনোযোগ দেয়নি। বরং মার্জিনে মন্তব্য যে কোনো সাহিত্যের ছাত্রের জন্য সুখপাঠের রেফারেন্স। কি দরকার অত জটিল ভাবনায় যাওয়া? ছন্দ, প্রকার-প্রকরণ আর গদ্যশৈলী নিয়ে খামোখা ভাবনার আগে শব্দ ও পাঠসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি নয় কি?